অবিভক্ত ভারতের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়ায় তাঁর জন্ম। বর্তমানে তা পশ্চিম বর্ধমান জেলা। এপার বাংলার সেই ভূমিপুত্র বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে এবার বাংলাদেশ দিল জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। শেষমেশ এল ঢাকার তরফে কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা।
১৯৭২ সালের ৪ মে বাংলাদেশে আসার তারিখ থেকে নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সংস্কৃতি মন্ত্রকের সচিব মহম্মদ আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়েছে এবং এটি সকলের অবগতির জন্য গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে গেজেট প্রজ্ঞাপন প্রকাশের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছিল।
কবি প্রয়াত হন ১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট। অর্থাৎ জাতীয় কবি হিসাবে মরণোত্তর স্বীকৃতি মিলল তাঁর। সরকারি অনুষ্ঠানে যদিও তাঁকে জাতীয় কবি বলে উল্লেখ করেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়ে আসছিল। বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামের গোড়াতেও ‘জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লেখা। কিন্তু তাঁকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে কোনও প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি এতদিন। কেন হয়নি, সরকার কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করবে কি না, এই সব বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশের হাইকোর্টে ২০২২ সালে মামলা হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষণায় গেজেট প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালতের তরফে নোটিস জারির নির্দেশ দেন হাইকোর্টের তৎকালীন দুই বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ডিভিশন বেঞ্চ।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী পরিচালককে আদালতে হলফনামার মাধ্যমে সরকারের বক্তব্য জানাতে বলা হয়েছিল। তারপর বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় থাকলেও আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।
কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে সরকারি উদ্যোগে সপরিবারে ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁর বসবাসের জন্য ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর (পুরনো) সড়কের ৩৩০-বি বাড়িটি বরাদ্দ করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অন্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বছরের ৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক সমাবর্তন উৎসবে এই উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অসুস্থতার জন্য নজরুলকে এই উৎসবে আনা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ নজরুলকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী নজরুলের উদ্দেশে একটি মানপত্রও পাঠ করেন।
নজরুল ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় প্রয়াত হন। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। কবির এই ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ শরিক হয়েছিলেন। জানাজার পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা-মোড়ানো নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোকদিবস পালিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্বোধন করে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮’ জারি করা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এস, ওয়াজেদ আলি, দীনেশচন্দ্র দাশ-সহ বহু বরণ্যে ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কাণ্ডারি’ এবং ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টারাও কবিকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে সর্বক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃত হলেও কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে ঘোষণা করে ইতোপূর্বে সরকারিভাবে কোনো গেজেট বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ সরকারের তরফে জারি করা হয়নি।
নজরুলকে নিয়ে কী বলছে বাংলাদেশ সরকার? সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি বা প্রজ্ঞাপন না থাকলেও জাতীয় কবি হিসেবে একাধিক নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নামের আগে জাতীয় কবি শব্দ দুটি যুক্ত করে একটি আইনও আছে বাংলাদেশে। সেটি হল ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬।’
‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘কবি’ অর্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একই ভাবে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে, অন্যান্য বইপুস্তকে, গবেষণাকর্মে, পত্রপত্রিকায়, সভাসমাবেশে সর্বত্রই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসবই ছিল পরোক্ষ স্বীকৃতি।