আজ ২৪ মে। আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। একই সঙ্গে তাঁর ভারত ছেড়ে সেদেশে যাওয়ার ৫০ বছর পূর্ণ হলে এদিন।
১৯৭২ সালের ২৪শে মে কলকাতা থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথমে অল্প কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আসার কথা থাকলেও তিনি কিন্তু বাকি জীবন ঢাকাতেই থেকে গিয়েছিলেন, কখনোই তাঁর আর ভারতে ফেরা হয়নি। কিন্তু কেন আর জন্মভূমিতে ফেরা হল না তাঁর? তাঁর জন্য কি ভারত সরকারের নিষ্ক্রিয় মনোভাব নাকি বাংলাদেশ সরকারের অতি উৎসাহী মনোভাব দায়ী?
ইতিহাস বলছে, বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় রাখা হয়েছিল কলকাতার রাজভবনে, যেটা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তখন এ এল ডায়াস, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।এই শহরেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম – তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। কবি নিজেও আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। তো এবারে আমরা চাই কবিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধুমধাম করে তাঁর জন্মদিন পালন করতে।’ উত্তরে ডায়াস বললেন, ‘অতি উত্তম প্রস্তাব – এমন তো হতেই পারে আমরা না হয় পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম, একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়! তবে দিল্লিই পারবে এই অনুমতি দিতে, ফলে আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গেই কথা বলুন।’ এরপর বঙ্গবন্ধু শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলাই নয়, এরই মধ্যে রাজভবনে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করলেন শেখ মুজিব। কবির দুই পুত্র, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধকেও তিনি জানিয়ে রাখলেন বাংলাদেশ সসম্মানে নজরুলকে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দিতে চায়।
এরপরই শুরু হল এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা – তিন দশক ধরে বোধশক্তিহীন, নির্বাক এক কবিকে ভিনদেশে পাঠানো নিয়ে চিঠি-চালাচালি, শলা-পরামর্শ আর ভাবনা-চিন্তা। ফেব্রুয়ারি থেকে মে – এই কয়েকমাসে নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ ও শরণ সিংয়ের মধ্যেও বেশ কয়েকদফা পত্রবিনিময় হয়েছিল। তবে দিল্লি সেগুলো আজও ‘ডিক্লাসিফাই’ করেনি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার মতামত চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন কংগ্রেসি নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের। কবি নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থাতেই নেই, ফলে দূত পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বললেন কবির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও। কাজী নজরুল ইসলাম বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বা তাঁকে একদিন সেখানে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হবে – এগুলো কিন্তু তখন জানা ছিল না, আর ভাবাও হয়নি।
আরও পড়ুন: Google Doodle: দেশের প্রথম মুসলিম মহিলা শিক্ষক ফাতিমা শেখকে কুর্নিশ গুগলের
নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক বাঁধন সেনগুপ্ত বিবিসিকে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে কবির পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই মতবিরোধ ছিল বলে অনেক নজরুল গবেষকই জানিয়েছেন। স্ত্রী প্রমীলার মৃত্যুর পর (১৯৬২) কবি তখন থাকতেন কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার ক্রিস্টোফার রোডে কাজী সব্যসাচীর পরিবারের সঙ্গেই।কাজী অনিরুদ্ধর কন্যা ও নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজীও কিন্তু অস্বীকার করছেন না যে তার বাবা ও জেঠু এই বিষয়টা নিয়ে ঠিক একমত হতে পারেননি।এরপর ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাট থেকে ট্যাক্সিতে রওনা দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকার বিমানে চাপলেন, কলকাতায় সেদিন কিন্তু সত্যিই কোনও তাপ-উত্তাপ ছিল না।
“আসলে ততদিনে শহরে নজরুল ক্রমশ বিস্মৃত হতে শুরু করেছেন। তাঁর সৃষ্টি থেমে গেছে বহু বছর আগেই, তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজনও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন”, বিবিসিকে বলছিলেন এই প্রজন্মের তরুণ নজরুল গবেষক ও গ্রন্থকার অর্ক দেব। প্রবীণ রাজনীতিবিদ সৌগত রায়েরও স্বীকার করেন, “কলকাতায় কিন্তু তখন নজরুলকে নিয়ে উন্মাদনা অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেন্টিমেন্ট, আবেগগুলো থিতিয়ে এসেছে। ফলে তিনি যখন ঢাকায় গেলেন বা সেখানেই থেকে গেলেন, কলকাতায় কোনও হই-চই হয়েছিল বলে আমার আদৌ মনে পড়ে না!”
চব্বিশে মে একটি বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে কলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় এসে পৌঁছেন কবি। তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে সেদিন হাজার হাজার উৎসুক জনতার ভিড়। নজরুল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ২০১১ সালে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ‘বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্পূর্ণ জনতায় ভরা আমার মনে আছে ২৪শে মে সকাল বেলা। বিমান থেকে নামলেন, পরিবার ছিল , সব্যসাচী, তার স্ত্রী খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী এরা সবাই ছিলেন। কিন্তু জনতার ভিড় এমন যে কবিকে বিমান থেকে নামানো যাচ্ছিল না।হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে কবিকে নেওয়া হয় তাঁর জন্য নির্ধারিত বাড়িতে। বিদ্রোহী কবিকে এক নজর দেখার জন্য বহু মানুষ ভিড় করেছিলেন ধানমন্ডির সেই বাড়িতেও।’
পৃথিবীর বহু বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিককে নানা কারণে স্বভূমি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তাঁরা কেউ একদিন নিজের দেশে ফিরতে পেরেছেন, কেউ কখনোই পারেননি। রাশিয়ার আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন, জোসেফ ব্রডস্কি বা বরিস পাস্তেরনাক, চেকোশ্লোভাকিয়ার মিলান কুন্দেরা বা চীনের বেই দাও – হাতের কাছেই এমন উদাহরণ অজস্র।
পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত কবি ও নজরুল একাডেমির সভাপতি জয় গোস্বামী মনে করেন, বাহাত্তর সালে কাজী নজরুল ইসলামও এক অর্থে দেশান্তরী হয়েছিলেন – তবে অন্যদের সঙ্গে তাঁর দেশান্তরী হওয়ার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে।
বিবিসিকে জয় গোস্বামী বলছিলেন, ‘অন্যরা কেন দেশ ছেড়েছিলেন? কারণ তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন রাষ্ট্র তাদের লিখতে দেবে না, পুরস্কার নিতে দেবে না, এমন কী প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে। জীবনের একটা পর্যায়ে নজরুলও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বহু লিখেছেন, তার রচনা নিষিদ্ধ হয়েছে – কিন্তু বাহাত্তরে যখন তিনি ঢাকা যাচ্ছেন তখন তাঁর ক্ষেত্রে একথাটা সত্যি ছিল না।আর দ্বিতীয় বিষয়টা হল, অন্য কবিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বা পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। নজরুলকে কিন্তু অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়ক প্রভূত সম্মান দিয়ে, বিরাট মর্যাদা দিয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাচ্ছেন! তখন তাঁর মেমোরি অব ওয়ার্ডস নেই, শব্দরা তাঁর স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, একটা লাইনও তিনি লিখতে পারেন না – তারপরও তাঁকে আপ্যায়নে, সম্মানে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা … আর এখানেই নজরুলের অনন্যতা। ‘
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে যে নজরুল চর্চা পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও অনেক বড় ক্যানভাসে ও অনেক ভালভাবে হয়েছে, সে কথাও নির্দ্বিধায় মানেন তিনি। আর তার পেছনে অবশ্যই একটা বড় কারণ হিসেবে থেকে গেছে বাহাত্তরের ২৪শে মে কবির ঢাকা যাত্রা, যেখান থেকে কোনও দিনই তাঁর আর কলকাতায় ফেরা হয়নি।
আরও পড়ুন: World Poetry Day: আজ বিশ্ব কবিতা দিবস, কোন কোন বাঙালি কবির বই নতুন প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি কিনছে