কলকাতার তরুণ সাহিত্যিকরা তখন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন। সেইসময় ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এলেন দিনাজপুরের ছেলে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তারকনাথ, বাল্যবন্ধু নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে লিখে ফেলেন তিনটি কিশোরপাঠ্য কাহিনি, ‘বিভীষিকার মুখে’, ‘নটরাজের চোখ’ এবং ‘একখানি কালো হাত’। গোল্ড মেডেল পাওয়া নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তোলা থাকল বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায়, আর আমার চিনলাম লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে ।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তার প্রথম লেখা ছাপা হয় মাস পয়লা শিশু মাসিকে। সন্দেশ, মুকুল, পাঠশালা, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় সুনন্দর জার্নাল লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বাঙালির জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, রোজকার সমস্যা ও রাজনীতি নিয়ে লেখা নিয়মিত এই জার্নাল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বাঙালি পাঠকের কাছে। এ সময় তিনি বড়দের জন্য আনন্দবাজার, বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি ও চতুরঙ্গে লেখালেখি করেন। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় কাব্যচর্চা দিয়ে। পরে তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। বড়দের জন্য রচিত প্রথম প্রকাশিত ‘উপনিবেশ’ ছাপা হয় মাসিক ভারতবর্ষে। ওটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। তার উপন্যাস-গল্প রচনার অনুপ্রেরণা যোগান উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় চৌধুরী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, মন্মথ সান্যাল, সজনীকান্ত দাস ও ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: রহস্য-রোমাঞ্চের কারিগর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন, দেখে নিন প্রিয় লেখকের কিছু অমূল্য লেখা
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর খ্যাতি বড়দের জন্য রচিত উপন্যাস ও গল্পের জন্য। কিন্তু শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনায় তার খ্যাতি বড়দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। টেনিদা তার অনন্য সৃষ্টি। এছাড়াও শিশুদের জন্যে অজস্র ছোটগল্প লিখেছেন। তার রচিত পদ্মপাতার দিন, পঞ্চাননের হাতি, লালমাটি, তারা ফোটার সময়, ক্যাম্বের আকাশ, বাংলা গল্প বিচিত্রা, ঘণ্টাদার কাবলু কাকা, খুশির হাওয়া, কম্বল নিরুদ্দেশ, চারমূর্তির অভিযান, ঝাউবাংলার রহস্য ও ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে নতুন সংযোজন।
বড়দের জন্য রচিত তার উলেস্নখযোগ্য বইগুলো হলো: একতলা, কালা বদর, কৃষ্ণপক্ষ, গন্ধরাজ, পন্নন্তর, ট্রফি, তিমির তীর্থ, দুঃশাসন, গদসঞ্চার, বনজ্যোৎন্সা, বিদিশা, বীতংস, বৈতালিক, ভাঙাবন্দর, চন্দ্রমুখর, মহানন্দা, রামমোহন, শিলালিপি, শ্বেতকমল, সাগরিকা, স্বর্ণ সীতা, সূর্যসারথী, সঞ্চারিণী, সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, সাপের মাথায় মণি, আশিধারা, ভাটিয়ালী, আগন্তুক, অমাবস্যার গান, বিদুষক, সাহিত্যে ছোটগল্প, বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ছোটগল্পের সীমারেখা ও কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ।
অনেকে ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসাঁর সঙ্গে তুলনা করেন তাঁকে। লেখকের কথায়, তিনি বিশ্লেষণপন্থী নন, আস্বাদনপন্থী। ফিকশন লেখার পাশাপাশিলিখেছেন বহু নন-ফিকশন ফিচার। ‘সুনন্দর জার্নাল’ নামে সেই লেখাগুলি কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অব্যক্ত সব ইতিহাসের সাক্ষী। আবার সাহিত্য সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষুরধার বিশ্লেষণের কথাও অস্বীকার করা যায় কি?