সূর্যতামসীর (Surjotamosi) প্লট ১৮৯৩ সালের ভারতবর্ষ,, আরও ঠিকভাবে বললে – কলকাতা আর চুঁচুড়ার গলিঘুঁপচি, চীনাপাড়া আর নিষিদ্ধ পল্লিতে। বইয়ের একটা অংশ অবশ্য বর্তমান ২০১৮’র টাইমলাইনে চলছে, তবে উনিশ শতকের কলিকাতা বর্তমান কলকাতাকে কাহিনীর ঘনঘটায়, বর্ণনার খুঁটিনাটিতে আর রহস্যময়তায় ছাপিয়ে গেছে বহুগুণে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা ছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। বিশেষ ডাক পেয়ে তাঁকে চিনাপাড়ায় যেতে হয়, একটি খুনের তদন্ত করতে। খুন হয়েছিল খুব নৃশংস পদ্ধতিতে। ঠিক তার কয়েকদিন পর জাদুর মঞ্চে খুন হলেন দুই জাদুকর। এই তিনটি খুন কি এক সুত্রে বাঁধা নাকি সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনা? এই খুনের তদন্তে দারোগা প্রিয়নাথ ও সারগাইসনকে সাহায্য করে বাঙালি প্রাইভেট গোয়েন্দা তারিণী রায় ও তার বন্ধু জাদুকর গণপতি।
দ্বিতীয় খুন ঘটেছে ২০১৮ সালে। এই প্রজন্মের প্রাইভেট ডিটেকটিভ তুর্বসু রায় । তুর্বসুর পরিচিত, বন্ধুসম এক ভদ্রলোক, দেবাশিষদাকে খুন করা সেই চিনাপাড়ার খুনের আদলে। খুনের ঠিক আগে দেবাশিষ তুর্বসুকে একটি অস্পষ্ট ছবি পাঠিয়ে কী সংকেত দিতে চেয়েছিলেন? কিন্তু কোন যোগসূত্রের কারণে এত বছর পর কলকাতার অন্ধকার ইতিহাস আবার সামনে এল? রহস্যের সমাধান খুঁজতে গিয়ে উনিশ শতকের প্রাচীন কলকাতার বিবরণ, তার অন্ধকারের ইতিহাস, গোপন ষড়যন্ত্র, সিম্বোলজি, দুর্ধর্ষ চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, ফ্রি ম্যাসন,মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা বিষয়ক চিকিৎসা ও চিকিৎসালয়, জাদুবিদ্যা,’সূর্যতামসী’ নামক ভয়ংকর কালোজাদুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
আরও পড়ুন: পাহাড়ের মানুষের আর্থ সামাজিক সংকট, মন কেমনের গল্প ‘নীল পাহাড়’ জুড়ে
সূর্যতামসী বইয়ের গদ্যভাষা ঝরঝরে, মেদহীন। যতটুকু ভিজ্যুয়াল বর্ণনা প্রয়োজন লেখক ঠিক ততটুকুই দিয়েছেন, লেখার সাথে গল্পের গাঁথুনি খুব ভালোভাবে এগিয়েছে। অন্যান্য বইয়ের তুলনায় চ্যাপ্টারগুলো ছোটছোট, তাই পাঠকে তরতরিয়ে পড়ে ফেলতে পারেন। প্রিয়নাথ দারোগার ডায়েরী, সেকালের গোয়েন্দা তারিণীচরণের ডায়রী, লেখকের দৃষ্টি থেকে তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা আর বর্তমান সময়ের প্রোটাগনিস্ট তুর্বসু নিজ বর্ণনা- বইটা চারটা ভিউপয়েন্ট থেকে লেখা, যা প্রায় প্রতি চ্যাপ্টার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রোটাগনিস্টদের চরিত্রায়ন যথাযথ, বিশেষ ভাবে বলতে হয় তুর্বসু চরিত্রটির কথা । পাঠক খুব সুন্দরভাবে ঐ চরিত্রটির সাথে একাত্মতা খুঁজে পাবেন ।
তবে এই বইয়ের প্রত্যেকটি পাতা খুব মন দিয়ে না পড়লে গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই বইয়ে যেমন প্রচুর তথ্য ভান্ডার তেমনি ওটাই সবচেয়ে বড় দুর্বল পয়েন্ট। চুঁচুড়ার নাম চুঁচুড়া কেন হল, ব্যান্ডেল এর নাম ব্যান্ডেল কেন , চন্দননগরের নাম চন্দননগর কেন, চন্দননগরের পাঠাগারের ইতিহাস নিয়ে পাতার পর পাতা খরচ করেছেন যার সাথে মূল উপন্যাসের কোনো যোগ নেই। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত ক্যারেক্টার (বিদেশী নাম বলে প্রায়শই খেই হারাচ্ছিলাম, বিরক্ত হয়ে মাঝপথে পড়া বন্ধও করে দিয়েছিলাম, কয়েকদিন পরে আবার শুরু করি।) আর সবশেষে কাহিনীতে প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের ভীড় একটু বেশিই… কে যে সত্যিকারের মূল চরিত্র সেই ব্যাপারে একটু যেন খটকাই থেকে যায় ।
তবে সবমিলিয়ে বলতে পারি… প্রচুর তথ্য এবং পাঁচটি প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টার সামলে যদি গল্পের মধ্যে ঢুকে যেতে পারেন, তাহলে ২৩০ পাতার বই শেষে পরের পর্ব ‘নিবারসপ্তক’ পড়ার আগ্রহ আপনার বাড়বে।
আরও পড়ুন: City of Joy খ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ডমিনিক ল্যাপিয়ের প্রয়াত