প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডে মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটির সুপারিশের সিলমোহর পড়ল লোকসভায়। শুক্রবার ধ্বনি-ভোটের মাধ্যমে স্থির হয় মহুয়ার ভাগ্য। সাংসদ পদ খারিজ হয়ে গেল তৃণমূল নেত্রীর।
এই ঘটনার সূত্রপাত সেই অক্টোবর মাসে। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল লোকসভায় প্রশ্ন করার জন্য তিনি নাকি শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে ঘুষ বাবদ নগদ ও নানা ধরনের উপহার নিয়েছেন। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এই ব্যাপারে প্রথম সরব হন। তারপর এই বিষয় নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলে সমান তালে। অবশেষে শুক্রবার মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ হল লোকসভায়।
গত ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদরাই সিবিআই ও লোকসভার স্পিকারকে চিঠি পাঠান। সেখানেই মহুয়ার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করা অভিযোগ করেন জয়। তবে মহুয়া প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। মহুয়ার দাবি ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করা হচ্ছে। এমনকী এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন তাঁর ‘প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড’ও! উল্লেখ্য বিষয়, একসময় মহুয়ার বয়ফ্রেন্ড ছিলেন জয়ই।
পুজোর ঠিক আগে আগে তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার বিরুদ্ধে সংসদে ‘ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন’ তোলার অভিযোগ এনেছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে।বিষয়টি নিয়ে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে চিঠি পাঠান দুবে। সেই চিঠিতে অবিলম্বে কৃষ্ণনগরের সাংসদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করা হয়। তাঁর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়ারও আবেদন করা হয়।
তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কতটা সত্যি, তা খুঁজে বার করতে লোকসভার স্পিকার এথিক্স কমিটিকে দায়িত্ব দেন বিষয়টি খতিয়ে দেখার। তার মধ্যেই মহুয়ার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তোলেন বিজেপি সাংসদ দুবে। প্রত্যেক সাংসদের একটি করে লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড রয়েছে। লোকসভার সচিবালয়ে কিছু জানাতে গেলে তার মাধ্যমে জানাতে হয়। দুবের অভিযোগ ছিল, মহুয়া তাঁর লগ ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড হীরানন্দানিকে দিয়ে দিয়েছিলেন। ওই ব্যবসায়ী দুবাইয়ে বসে প্রশ্ন লিখে দিতেন। যা দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বলেও অভিযোগ করেন বিজেপি সাংসদ।
এরই মধ্যে মহুয়ার বিরুদ্ধে শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানি একটি হলফনামা দাখিল করেন। তিনি দাবি করেন, মহুয়া তাঁকে ব্যবসায়িক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামে তাঁর কাছ থেকে অন্যায্য সুযোগ নিয়েছিলেন। মহুয়ার আবদার ও বায়নাক্কা মেটাতে গিয়ে তাঁকে দামি উপহার, বিদেশে ছুটি কাটানোর খরচ, দিল্লির বাংলো মেরামত করে অনেক কিছু করেছেন। মহুয়া মৈত্র নিজে অবশ্য এই সব দাবি মানতে চাননি। মহুয়া জানিয়েছিলেন, বন্দুকের নলের মুখে বসিয়ে দর্শনকে দিয়ে এসব কথা বলানো হচ্ছে। তার ব্যবসা বন্ধ করে দেবে বলেও বলা হচ্ছে।
এক সাক্ষাৎকারে মহুয়া স্বীকার করে নেন, তিনি ব্যবসায়ী হীরানন্দানির কাছ থেকে কয়েক বছর আগে আইশ্যাডো আর লিপস্টিক উপহার পেয়েছিলেন জন্মদিনে। তবে দু’কোটি টাকা নগদ নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা ভুয়ো বলে ওই সাক্ষাৎকারে উড়িয়ে দেন মহুয়া। মহুয়া এ-ও দাবি করেন, একটি বিদেশি প্রসাধনী প্রস্তুতকারক সংস্থার ওই সামগ্রী তাঁকে হীরানন্দানি কিনে দিয়েছিলেন জন্মদিনের উপহার হিসাবে। মহুয়া আরও জানান, মুম্বই গেলে বন্ধু হিসাবে হীরানন্দানি বিমানবন্দরে তাঁর জন্য গাড়ি পাঠাতেন। ভবিষ্যতে মুম্বই গেলেও তিনি বন্ধু হীরানন্দানিকে বলবেন।
এদিকে এসবের মধ্যেই একটি Rottweiller কুকুরকে ঘিরেও নানা কথা উঠতে থাকে। দেখা যায় একই কুকুরের ছবি পোস্ট করছেন অনন্ত ও মহুয়া। কুকুরের নাম হেনরি। অনন্ত আর মহুয়া উভয়েরই প্রিয় এই কুকুর। সেই হেনরি কার কাছে থাকবে তা নিয়েও মহুয়া ও অনন্তর মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল বলে খবর। তবে কি তার পরিণতিতেই এত বড় কাণ্ড!
মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে এথিক্স কমিটি। কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ সোনকার জানিয়েছিলেন, ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের জন্য সমস্ত দিক যাতে খতিয়ে দেখা যায়, সেইজন্য তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দেওয়া হয়। সবকিছু খতিয়ে দেখে কমিটি গত ৩১ অক্টোবর তদন্তের স্বার্থে মহুয়াকে তলব করে।
তবে মহুয়া জানান, ৩১ অক্টোবর তিনি হাজিরা দিতে পারবেন না। ৫ নভেম্বরের পরেই এথিক্স কমিটির সামনে হাজির হতে পারবেন। কিন্তু মহুয়ার আবেদনের পাত্তা দেয়নি এথিক্স কমিটি। ২ নভেম্বর মহুয়াকে হাজির দিতেই হবে জানিয়ে দেয় তারা। গত ২ নভেম্বর এথিক্স কমিটির সামনে হাজিরা দেন মহুয়া। যদিও সেই বৈঠকের মাঝপথেই মহুয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, কমিটি তাঁকে ‘নোংরা’ প্রশ্ন করেছে। যা খুবই অপমানজনক। পাল্টা কমিটিও মহুয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তদন্ত শেষে তারা মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করে।
এর পর জানা যায় ৭ নভেম্বর বৈঠকে বসবে এথিক্স কমিটি। সেই বৈঠকেই মহুয়ার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করা হবে সে বিষয়ে কমিটি তাদের রিপোর্ট চূড়ান্ত করবে। তবে সেই বৈঠক পিছিয়ে দেওয়া হয়। ৭ তারিখের বদলে ৯ তারিখ বৈঠকে বসবে বলে জানানো হয় লোকসভার এথিক্স কমিটির তরফে। এর মধ্যেই ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় এথিক্স কমিটির খসড়া রিপোর্ট ‘ফাঁস’ হয়ে যায় একটি টিভি চ্যানেলে। সেখানে দাবি করা হয়, এথিক্স কমিটি মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের ব্যাপারে সুপারিশ করবে লোকসভার স্পিকারের কাছে।
খসড়া রিপোর্ট ‘ফাঁস’ হওয়ার পর লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি লেখেন মহুয়া। এথিক্স কমিটির গোপন রিপোর্ট কী ভাবে একটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের হাতে পৌঁছে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ। এর পর জানা যায়, এথিক্স কমিটি মহুয়াকে সংসদ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে। পক্ষে ভোট পড়ে ছ’টি, বিপক্ষে চারটি।
এর পর সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয় ৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ, গত সোমবার। বিজেপি সূত্রে গত এক মাস ধরেই বলা হচ্ছিল, অধিবেশনের প্রথম দিনই তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে সংসদের এথিক্স কমিটি। কিন্তু দেখা যায়, সোমবার আনুষ্ঠানিক ভাবে লোকসভার স্পিকারের কাছে এথিক্স কমিটি রিপোর্ট পেশ করেনি। ফলে মহুয়ার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ হবে, তা-ও স্পষ্ট হয়নি শীতকালীন অধিবেশনের শুরুর দিন। এর পর শোনা যায়, শুক্রবারই মহুয়া সম্পর্কে লোকসভার স্পিকারের কাছে এথিক্স কমিটির রিপোর্ট জমা পড়বে। হয়েছেও তাই।
লোকসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার পর দুপুর ২টো পর্যন্ত তা স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবার অধিবেশন শুরুর পর ‘প্রশ্নঘুষ’কাণ্ডে মহুয়াকে বহিষ্কার করার সুপারিশ করে লোকসভার এথিক্স কমিটি। ৪৯৫ পৃষ্ঠার রিপোর্ট তারা শুক্রবার জমা দেয়। ওই রিপোর্ট পড়ে দেখার জন্য সময় চেয়েছিল তৃণমূল। কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলির তরফেও স্পিকারের কাছে সময়ের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু স্পিকার সময় দেননি।
মহুয়াকেও বলার সুযোগ দেননি স্পিকার ওম বিড়লা।এর পর ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে মহুয়াকে বহিষ্কারের সরকারের পক্ষের প্রস্তাব পাশ করা হয়।