শেষ হল জুনিয়র ডাক্তার-মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক। কখনও জুনিয়র ডাক্তারদের ‘বাবু’, কখনও ‘বাবা’ সম্বোধনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সব দাবি যে মানা সম্ভব নয় তাও আজ বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সোমবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। জানানো হয়েছিল, ডাক্তারদের ১০ জন প্রতিনিধি বৈঠকে যোগ দিতে পারবেন। এদিন নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগেই নবান্নে পৌঁছয় ডাক্তারদের ১৭ জনের প্রতিনিধি দল। জানা গিয়েছে, বৈঠকে থাকবেন কলকাতা মেডিক্যালের অধ্যক্ষ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস, এসএসকেএমের সুপার পীযূষ রায়, আরজি করের অধ্যক্ষ মানস কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তারদের ১৭জন প্রতিনিধিকেই বৈঠকে অংশ নিতে বলা হয়।
নবান্নের তরফে জানানো হয়েছিল, নবান্নে ৪৫ মিনিট জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা হবে। যদিও এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিট কেটে গেলেও শেষ হয়নি বৈঠক। প্রায় দু’ঘণ্টা পর বৈঠক শেষ হয়।
দেবাশিস, অনিকেত, কিঞ্জলরা নবান্ন সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তাঁদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। প্রসঙ্গ আসে ডায়মন্ড হারবারে এদিনের ঘটনার কথাও। ডায়মন্ড হারবার প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমি টিভিতে দেখেছি সেখানে একজনকে জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। এটা কি ‘থ্রেট কালচার’ নয়? এখানেই থামেননি মমতা। আর্জি কর থেকে কেন ৪৭ জনকে সাসপেন্ড করা হল সেই প্রসঙ্গও তুলে ধরেন।
এরপর অনিকেত মাহাতো মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘যাঁদের চিহ্নিত করে সাসপেন্ড করা হয়েছে তাঁরা ‘নটরিয়াস ক্রিমিনাল’। মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, ‘সরকারকে না জানিয়ে এভাবে কি কাউকে সাসপেন্ড করা যায়?’ বৈঠকে উপস্থিত জুনিয়র ডাক্তাররা বলেন, ‘কলেজ কাউন্সিল রয়েছে। সেই কাউন্সিল তদন্ত করে তাঁদের সাসপেন্ড করেছে’। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘কলেজ কাউন্সিল সরকারকে না জানিয়ে এসব করতে পারে না। পরক্ষণেই আরজি করের প্রিন্সিপাল কিছু বলতে চান। মমতা তাঁকে থামিয়ে দেন।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে এও বলেন, ‘শেষ তিন বছরে যাঁরা পাশ করে গেছেন, তাঁদের খাতা খতিয়ে দেখা হোক।’ পাল্টা জুনিয়র ডাক্তাররা বলেন, ‘এই ৪৭ জনের মধ্যে অনেক অভিযুক্তের খাতা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, অনেকেই ১০ নম্বরও পাননি, অথচ পদক পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। হাউস স্টাফও হয়েছেন।’
সুপ্রিম কোর্টে জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবীকে কটাক্ষ করলেন মমতা। তিনি জানালেন, কোর্টে ওই মহিলা আইনজীবী দাবি করেছেন, রাজ্যের হাসাপাতালে তুলোও পাওয়া যায় না। এর পরেই তিনি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষদের প্রশ্ন করেন, ‘‘এটা কি ঠিক? এতে রাজ্যের মুখ পুড়ল।’’
আন্দোলনকারী ছাত্রীর কথায়, টাস্ক ফোর্স কী কাজ করছে, সে সংক্রান্ত তথ্য তাঁদের কাছে নেই। টাস্ক ফোর্সে সব মেডিক্যাল কলেজের প্রতিনিধিকে রাখার দাবি জানালেন দেবাশিস। মুখ্যসচিব জানিয়ে দিলেন তাতে থাকবেন ৯ সদস্য। রোগী কল্যাণ সমিতিতেও থাকবে জুনিয়র ডাক্তাররা, জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন হবে বলেও জানালেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, একদিনে সমস্ত দাবি পূরণ সম্ভব নয়। এর জন্য সময় ও টাকা, দুটোই প্রয়োজন। তবে ধাপে ধাপে দাবি পূরণ হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নিজেরা নিজেদের ইগো নিয়ে থেকে গেলে কিন্তু সলিউশন আসবে না। পরিস্থিতি এবার স্বাভাবিক করুন।’ পাল্টা আন্দোলনকারী এক মহিলা ডাক্তার জানান, ‘আন্দোলন আপনার থেকেই শিখেছি।’ উত্তরে মমতা বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের দাবিতে ২১ দিন ধর্না করেছিলাম। সিঙ্গুর নিয়ে ২৬ দিন অনশন করেছি। কেউ আসেনি। গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ব্যক্তিগত ভাবে আমায় ভালবাসতেন বলে এসেছিলেন।আমি মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবকে পাঠিয়েছি। রোজ খবর নিয়েছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রিপোর্ট নিই।’
মমতা জুনিয়র ডাক্তারদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কথা বললেন। তাঁর কথায়, ‘‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সরকার কাজ করবে কী করে?’’ ডাক্তারদের আন্দোলনেই ভোগান্তিতে আমজনতা। বাড়ছে স্বাস্থ্যসাথীর খরচ, এটা অপরাধ নয়? প্রশ্ন তুললেন মমতা। বললেন, “ডাক্তারদের অনশনের জন্য রাজ্যের খরচ হয়েছে ৪৫০ কোটি।”
মমতা বলেন, ‘‘রং জানার দরকার নেই। পরিচয় জানার দরকার নেই। যদিও জানি সব। ৫৬৩ জন আন্দোলন চলার সময় বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করে টাকা নিয়েছেন।’’ অনশন তুলে জুনিয়রদের কাজে ফেরার পরামর্শ মুখ্যমন্ত্রীর। বললেন, ‘ঘরের দরজা বন্ধ করো, মনের দরজা নয়’।
সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ মমতা বলেন, কুলতলির নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আছে। আজকের বৈঠক এখানেই শেষ হোক। এরপর জুনিয়র চিকিৎসকরা ধর্মতলার অনশন মঞ্চে ফিরে যান। ধর্মতলায় ফিরেই বৈঠকে বসলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। শোনা যাচ্ছে, আগামিকাল বিকেল ৩ টে পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সমস্যা সমাধানের লিখিত প্রতিশ্রুতি পেলে তার পর অনশন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। তবে ক্ষেত্রে আগামিকালের স্বাস্থ্য ধর্মঘট নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা এখন দেখার।