‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ কথাখানি সবক্ষেত্রে সত্যি নয়। এমন ভাবনায় দ্রবীভূত আবেগ রয়েছে। আগের বহু কিছুই খারাপ এবং অসুন্দর, এমনটা এমনটা সত্যি নয় । আসলে মন আমাদের সুস্থ রাখতে চায়। সতেজ রাখতে চায়।তাই আগের ভালো স্মৃতিকে মন সেভ করে রাখে। খারাপ অভিজ্ঞতার ওপর একটা আস্তরণ বিছিয়ে দেয়। কম বয়সে বহু কিছু সুন্দর মনে হয়। দুনিয়া দেখার চোখ এবং মন আলাদা থাকে। মনে একটা ভালো লাগা থাকে।
শৈশবে এবং কৈশোরে অহেতুক হাসি পায়। কেন এমন করে হাসি পায় বুড়ো বয়সে হাজার ভেবেও সে রহস্য উন্মোচিত হয় না। বুড়ো বয়সে সহজে হাসি পায়না। মন ভালো থাকে না। অতীতের কথা মনে হয়। যৌবনের সোনালী দিনগুলিকে বড় মধুর মনে হয়। কিন্তু সোনালী জীবন কাটানোর সময় সে বোধ কাজ করে না। পড়ন্ত বিকেলে এসে কঠিন সংগ্রামের সেই দিনগুলোকেও সুন্দর মনে হয়। সেই সময় যে লোকগুলিকে কুঠিল ও জটিল মনে হয়েছে, বুড়ো বয়সে মন তাদের ভিন্ন চোখে দেখে। মন বলে লোকগুলো বেশ ছিল। আগের সেদিন গুলো আর নেই। এই একই কথা হাজার হাজার বছর ধরে এই দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
আসলে সবটাই নস্টালজিয়া (nostalgia)। এটি মনে গভীরে কাজ করে। বয়স যত বাড়ে মন তত নস্টালজিক(nostalgic)হয়।পুরোনো দিন, পুরোনো সম্পর্ক ও পুরোনো মানুষগুলোকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে।একটা গভীর যন্ত্রনা বোধ কাজ করে। কবি প্রদীপ তাঁর শায়েরিতে লিখেছেছিলেন,
‘সুরাজ না বদলা
চাঁদ না বদলা
না বদলা রে আসমান
কিতনা বদল গায়ে ইনসান।’
‘দেখ তেরা সংসার কি হালত’ ছবিতে এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রসঙ্গত কবি প্রদীপের (Kavi Pradeep) লেখা যে অমর গান গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তা হল, ” অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো যারা আঁখ মে ভর লো পানি” লতার(Lata Mangeshkar) কণ্ঠে এই গান শুনে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর চোখে জল এসে গিয়েছিল।
সত্যিই কিছু বদলায় না। সব ঠিক থাকে। কেবল মানুষ বদলে যায়। সম্পর্কে বদলে যায়। মানুষ নস্ট্যালিজকে হয়। এই নস্টালজিয়া আসলে কি। কেন তা এমন করে কষ্ট দেয়। ১৭ শতকে তা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে সামনে আসে। ফরাসি চিকিৎসক জোহানাস হোফার প্রথম বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাব প্রতিষ্ঠিত করেন।
কিছু ভাড়াটে সুইস সেনা বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিল। বিদেশের মাটিতে তারা লড়াইকরতে এসেছিল। অসুস্থ হওয়ার কারণে ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকরা তাদের অসুখ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু দিন দিন এই সেনারা দুর্বল হয়ে পড়ছিলো। কারও ঘুম হয়না ,কারও হার্টবিট ইরেগুলার, কারোবা বা গায়ে জ্বর, কেউ কেউ এমন ছিলেন যারা যা খাচ্ছেন হজম করতে পারছেন। কিছু জনা ছিলেন ভীষণ রকমের ক্লান্ত।
কেন এমন হচ্ছে তা জানতে সেদিনের মেডিক্যাল পড়ুয়া জোহানেস হোফার শুরু করেন অনুসন্ধান। পরে তিনি বোঝেন শারীরিক সমস্যার কারণে তাদের এ হাল নয়, আসলে তারা প্রত্যেক বাড়ি ফিরতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। কবে ফিরতে পারবেন তাও তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। একটা তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন সকলেই। পাহাড়ি হোমল্যান্ডে ফেরার তীব্র আকুতি এই সেনাদের অসুস্থ করে তুলছিল।
হোফার তখন এই মানসিক সমস্যার নাম দেন ‘নস্টালজিয়া’।গ্রিক ভাষায় নস্টোস কথার অর্থ হোম কামিং অর্থাৎ বাড়ি ফেরা আর ‘আলগোস’ শব্দের অর্থ যন্ত্রনা অথবা কোনো জিনিসকে দীর্ঘদিন ধরে প্রবলভাবে চাওয়া। যাইহোক তখন থেকেই এই নস্টালজিয়া (nostalgia) শব্দের উৎপত্তি। একটা সময় একে মানসিক সমস্যা হিসাবে দেখা হত। কিন্তু পরে দেখা যায় নস্টালজিয়া একটি কমন বিষয়। এটি ক্ষতিকারণ নয়। বরং এটি পজিটিভিটি নিয়ে আসে। সামাজিক বন্ধন মজবুত করে। গভীর পজিটিভ ইমোশনের জন্ম দেয়।নস্টালজিয়া সব সময় ভালো স্মৃতি বহন করে। মনকে নরম করে। ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার জন্ম দেয়।