সৈয়দ আলি মাসুদ
পড়ুয়াদের মধ্যে বাড়ছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বহর। কমছে সহবত। এই শব্দটি আসলে আরবি। কিন্তু বাঙালি সহবত শব্দকে বহুকাল ধরে আপন করে নিয়েছিল। এর বাংলা মানে হল ‘সংসর্গ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা।’ শব্দটি বাংলায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেই নবাবী আমল থেকে।
আজকাল চারিদিকে বাড়ছে ঝাঁ চকচকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা। সেখান থেকে পড়ুয়ারা ম্যানার্স কিংবা এটিকেট শিখছে। কিন্তু সহবত সেখানে সেখানো হয় না। ম্যানার্স কিংবা এটিকেট পশ্চিমা শব্দ। তার যোগ পশ্চিমের সমাজের সঙ্গে। সহবত আমাদের পরিচয়। এই পরিচয় আমরা বহুকাল ধরে বহন করছি। আজও বহু পরিবার তা ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাঙালি পরিবারে বড়দের আচরণ ও তাদের কথাবার্তা শুনে ও অভিব্যক্তি দেখে ছোটরা সহবত শিখত। কিন্তু আজকাল বাঙালি পরিবারের বড়রাই নিজেদের দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা, স্কুলে তো এত টাকা দিয়ে পড়াচ্ছি, তাহলে আর আমাদের সহবত শেখানোর দায় কোথায়? এর দায়িত্ব তো স্কুলের।
স্কুল থেকে তারা শিখছে, সাজেশন, নোট ও পরীক্ষায় ভালো ফল করার কৌশল। মেধাকে কত সহজে কৌশলের মাধ্যমে টপকানো যায় তার পাঠ দিচ্ছে নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষা এখন সবার কাছে ওপারচুনিটি। পড়ুয়া এবং তাদের অভিভাবকরা সকলেরই দরকার বেশি নম্বর। ফলে সব স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সেদিকে দিকে নজর দিচ্ছে। কারও নজর নেই সহবতের দিকে। সবার কাছে সহবত একটি মূল্যহীন বিষয়।
এখন ‘সরি’ বলার চল বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই দুঃখপ্রকাশেও কোনও বিনয় থাকে না। এই দুঃখ প্রকাশ করার সময়ও অনেকের অভিব্যক্তি ও কণ্ঠস্বরে থাকে অদ্ভুত কাঠিন্য। সহবত না জানার কারণে তারা দুঃখ প্রকাশের সু¨র ভাবটুকুও প্রকাশ করতে পারছে না। আসলে আদব বলে জিনিসটা সত্যিই সমাজ থেকে উবে যাচ্ছে। বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, কোন কথা কখন কীভাবে বলতে হয়, তা আজকের প্রজন্মের অনেকে জানেই না। গলা উঁচিয়ে ইংরেজিতে কথা বলাকে এরা অনেকেই স্মার্টনেস মনে করে। কিন্তু বাঙালি বহুকাল ধরে যাকে চিনত সেই সহবত দিন দিন বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। আগে একটা প্রচলিত কথা ছিল ‘যদি হও ভালো মানুষের পো, লেখা পড়ায় যেমন তেমন সহবতে থো।’ এর অর্থ ভালো মানুষের সন্তানরা লেখাপড়াতে যেমনই হোক না কেন, তার পরিচয় হত সহবত। সেই সহবত ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পরিবারের সকলের। যদি না হয় সহবত কেবল অভিধানে দাফন হয়ে থাকবে । এর বাস্তব প্রকাশ থাকবে না ।