সৈয়দ আলি মাসুদ
রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট আর ১৯৪২-এর ১০ জুলাই কাজি নজরুল ইসলামের স্নায়ুবৈকল্য প্রকট হল। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন কবি, সেই স্বাধীনতা যখন এল, তখন ফুলের জলসায় কবি নীরব।নজরুলপ্রেমীরা অনেকেই বলেন, নজরুলের প্রতি অবিচার হয়েছে। তাঁকে কোনওকালে বোঝার চেষ্টা হয়নি। কয়কেটি গান এবং কবিতা দিয়ে তাঁকে বিশ্লেষণের চেষ্টা মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। অভিমানের এই কথাগুলি ফেলে দেবার নয়। কথা সত্য। সেই অভিমানেই অন্নদাশঙ্কর ১৯৪৯-এ লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’, সমস্ত হতাশার মধ্যেও তা আমাদের বড় এক আশার আলো। এই ছড়ার শেষে অন্নদাশঙ্কর আরও বলেছিলেন, এই ‘ভুলটুকু’ বেঁচে থাকার মধ্যে বাঙালির সব দুর্গতি যেন ঘুচে যায়, তা এখনও আমাদের আশার মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে।
নজরুলকে বোঝা সহজ ছিল না। কিন্তু তাঁর সাহিত্য ও কাব্য নিয়ে এ বঙ্গে তথা দেশে আরও চর্চা জরুরি ছিল। ব্যক্তি নজরুল ছিলেন আকাশের মত। তাঁর চেতনা, তাঁর মানবতার নাগাল পাওয়া ছিল অসম্ভব। তাঁর উদারতার তুলনা হতে পারে সাগরের সঙ্গে। নজরুলের মত এমন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব সেই সময় আর একজনও ছিলেন কিনা সন্দেহ। সাহিত্যের মুকুট এমন অনেকের মাথাতেই চাপানো হয়েছিল, যাদের লেখার মধ্যে ছিল ‘বিশেষ বিদ্বেষ’। সমাজ জীবনে তো নয়ই, সাহিত্যক্ষেত্রেও তারা সচেতনভাবে ভালো মুসলিম চরিত্র তৈরী করতে পারেননি।মতান্তরে চাননি। এই সব মহান সাহিত্যিকদের বঙ্গবাসী চেনেন। আলাদা করে নাম উল্লেখ বাতুলতা।
আরও পড়ুন : Remembering Raja Ram Mohan Roy :সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঙালি রাজা রামমোহন রায়,
ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে, নজরুল প্রসঙ্গে ফেরে আসা যাক। সচেতনাবশত কিংবা উদাসীনতাবশত নজরুলের সাহিত্য ও সংগীতের বহু দিকের প্রতি আমরা উদাসীন থেকেছি। অনেকে বলেন, এ উদাসীনতা আসলে লালন করা হয়েছে।ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমে যেমন একজন, বড়জোর দু’জন মুসলিম প্লেয়ার থাকেন, নজরুল এ পার বাংলার অনেকের কাছে তেমনই সাহিত্য ও সংগীতের একজন ‘মুসলিম প্লেয়ার’। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাহিত্যের বরপুত্র বললেন, নাকি বসন্তের কবি বললেন, তা দিয়ে নজরুলের বিশ্লেষণ হয় না। তবে এই শংসা উপেক্ষা করারও নয়।
২৫ মে কবির জন্মদিন। সেই উপলক্ষে আর একবার তাঁকে স্মরণ করা যাক।উইকিপিডিয়ায় নজরুলকে লেখা হয়েছে বাংলাদেশী কবি। যারা লিখেছে তাদের আর দোষ কি। সত্যিই তো, যারা তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিল, তারা তো বলতেই পারে তিনি তাদের। আমরা পারিনি। যাক, এ অভিমান চিরন্তন। এবার তাঁর সাহিত্য ও সংগীতের বিশেষ দিক নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। সাহিত্য ও সঙ্গীত, নজরুলের মূল দুই বিচরণক্ষেত্র। সেখানে তাঁর স্বকীয়তা বিবিধতায়, বহুত্বে। এই বহুত্ববাদী চরিত্রই সম্ভবত নজরুলের সৃষ্টির মূল কথা।
পাঠকসমাজের কোনও অংশে নজরুল-সাহিত্যের দুর্বোধ্যতা নিয়ে অভিযোগ শোনা যায়। এই অভিযোগ যারা করেন, আমার মতে তাঁরা গোঁড়া। মৌলবাদী। সমাজ ও সাহিত্যকে দেখার চোখ তাদের একপেশে। নজরুলের কবিতা, সাহিত্যে ও সংগীতে ও আরবি ও ফার্সি শব্দ রয়েছে। যা উচ্চারণেও অনেকটা খাঁটি। তাদের বঙ্গীকরণ হয়নি। ফলে তাদের ‘মুসলমানি’ মনে করেছেন অনেকেই। আজ বাংলা শব্দভাণ্ডার আরবি, ফার্সি ছাড়া কার্যত অচল। এই আবাল বঙ্গবাসী তাদের বিকৃত উচ্চারণে বহু আরবি ও ফার্সিকে বাংলা বানিয়ে ফেলছে। সেটাকে তারা বাংলা বলে ধরে নেয়।
নজরুলের বিচরণ ছিল সমাজের সর্বস্তরে। এমনটা বোধকরি, তাঁর জমানার আর কোনওকবি কিংবা সাহিত্যিকের ছিলনা। হিন্দু-মুসলিম একটা ছুৎমার্গ তাদের বেশিরভাগেরই ছিল। কেউ কেউ সচেতনভাবে তা লালন করতেন। কেউ কেউ ইংরেজ এবং হিন্দুদের কাছে বাহাদুরি পেতে সব সৌজন্য ভুলে গিয়ে ‘নেড়ে’ শব্দ ব্যাবহারে কুন্ঠিত হননি।
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে, তার উৎসও এখানেই । নানা কৃষ্টির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা কবিতা সব পাঠকের কাছে পৌঁছনো সহজ নয়। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলি যে সমাজ-জীবন থেকে উঠে আসছে, সে সম্পর্কে অবহিত না থাকলে কবির অভিপ্রায় অনুধাবনে বাধা আসবেই। বিঘ্ন তৈরি হবে, যদি তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝা না যায়।
দুটো কবিতা গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করলে নজরুলকে বোঝা যায় না। নজরুলকে শব্দ দিয়ে নয়, বুঝতে হবে চেতনা দিয়ে। বিদ্বেষ বিষে তাঁকে বোঝার চেষ্টা না করাই ভালো। শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা কেউ কেউ আজও বাঙালি ও মুসলমানকে আলাদা মনে করেন। সেই হিসাবে ভালোই হয়েছে যে নজরুল মসজিদের পাশে মোয়াজ্জিনের আজান শুনছেন। এ বাংলায় থাকলে হয়তো তিনি কেবল মুসলমানের কবি হয়েই থেকে যেতেন। তাঁকে রেখে দেওয়া হত। এ কথা উঠলেও একদল আঁতেল দায় এড়াতে নানা কাসুন্দি গান। আজও বহু বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী মনে করেন মুসলিম আবার বাঙালি হয় কি করে? তারা তো মুসলিম! এইভাবে আপন ধর্মাচরণকে সংষ্কৃতি বলে সেদিনের মত আজও চালিয়ে যাচ্ছেন বহু বুদ্ধিজীবী। মুসলিমের বেলায় সবটাই ধর্ম। সেখানে সংস্কৃতি অমিল।
নজরুল সম্পর্কে যা বলা হয়ে থাকে তা হল,১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। বাহাত্তরের মে মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আবেদন জানালেন, কবির তিয়াত্তরতম জন্মদিনটি তাঁরা উদযাপন করতে চান স্বাধীন বাংলাদেশে। নজরুল সেই যে বাংলাদেশে গেলেন আর তাঁর ভারতে ফেরা হল না। তাঁর দেখভালের সুন্দর ব্যবস্থা করলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তো ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে নাগরিকত্বই দেওয়া হল। সত্যিই কি ব্যাপারটি এমন লটে গাছটি মুড়োনা টাইপ ছিল? একটা দায়ছাড়া ভাব কি আমাদের ছিল না ? আমরা কি নজরুলকে কাছে রাখার আন্তরিক চেষ্টা করেছি ? প্রশ্ন হল কেন করেনি ? এর উত্তর প্রীতিকর নয়। বিশ্বখ্যাত শিল্পী এমএফ হুসেন কে কি মনে আছে? তাঁকে কি আমরা রাখতে পেরেছি? একটা কি যোগসূত্র নেই ? সুধী পাঠকের কাছে ভাববার অবকাশ প্রার্থনা করছি।
আরও পড়ুন : Rabindra Jayanti 2021: হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর