সৈয়দ আলি মাসুদ
মোদীত্বের দাপটে কোনঠাসা হিন্দুত্বও। মোদী জমানায় যে হিন্দুত্ব দেশজুড়ে সংখ্যাগুরু তরুণ প্রজন্মকে উত্তেজিত করেছে, তাকে আর যাই হোক হিন্দুত্ব বলা যায় না। একে বলা যেতে পারে হিন্দুত্বের ‘রিমিক’। বিকশিত ভারতের এমন নয়া হিন্দুত্বের তাল মেলাতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছেন পুরাতনরা । কেউ কেউ খানিক বিরক্তও। বিজেপির শীর্ষনেতারা যখন মোদীকে সামনে রেখে লাফাচ্ছিলেন, তখন আরএসএস বলেছিল এবারের ভোটে ২০০ আসনও হয়তো পার করতে পারবে না বিজেপি। মল্লিকার্জুন খাড়গে বহুবার আরএসএসের এই নির্বাচনী পূর্বাভাসের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। তবে প্রকাশ্যে আরএসএসের কেউ তা নিয়ে মুখ খোলেননি। আরএসএসের সাবধানবাণীতে কান দেয়নি ‘মোদীর বিজেপি’।
গোদি মিডিয়ার তোষামোদে রিপোর্টের ওপর ভরসা করে মোদী মনে করেছিলেন তিনি একাই ম্যাচ বের করে দেবেন। ফলে রিপোর্ট কার্ড ছাড়াই কেবল বিদ্বেষের তীর ধনুক নিয়ে দেশ পরিক্রমায় বের হয়েছিলেন। তিনি যেভাবে আরএসএসকে বাইপাস করে পুঁজিপতি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সাহায্যে বিজেপিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন তা সংঘ পছন্দ করেনি। বিজেপির ওয়াশিং মেশিন হয়ে ওঠাতেও গোপন বৈঠকে আপত্তি জানিয়েছিল সংঘ। কিন্তু ততদিনে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলেছে মোদীবাহিনী। সোশ্যাল সাইটকে ভিত্তি করে মোদীর ভক্তকুল বানিয়ে তোলা হয়েছে। ফলে দল নয়, ক্রমশ ব্যক্তি মোদীকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সবমিলিয়ে পোড় খাওয়া আরএসএস সদস্যরা অনেকেই এই ভোটে খানিকটা নির্লিপ্ত হয়ে পড়েন। উত্তরপ্রদেশে যার ফল ভুগচ্ছে বিজেপি। সংঘ পাশে না থাকলে কেবল যোগী-মোদীর ছবি দিয়ে আর রামের নামে যে জয়ী হওয়া যায় না এবার মোক্ষম টের পেল বিজেপি।
আরএসএসের সদস্যরা আবেগে নিয়ে সংগঠন করে। তারা হিন্দু আধিপত্য চায়,হিন্দুরাষ্ট্র চায়, কিন্তু আর্থিক দুর্নীতির দায় তাদের গায়ে লাগুক তা চায় না। কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড নামক তোলা আদায়ের যে কল মোদীর দল করেছিল তা বেনাকাব হয়ে গেলে ক্ষুব্ধ হয় আরএসএস। সংঘের বক্তব্য, তাহলে মানুষ আর কেন তাদের ওপর আস্থা রাখবে। মোদীর জমানায় একের পর এক দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বরণ করা হয়েছে বিজেপিতে। গোপন বৈঠকে তাতে আপত্তি তুলেছিল আরএসএস।
এখানেই শেষ নয়। নিজের দাপট বাড়াতে আরএসএসের পছন্দের নেতাদের ডানা ছাঁটা শুরু হয় মোদীর নয়া ভারতে। মোদী নিজে যতবার বিজেপির কথা বলেছেন তার থেকে অনেক বেশিবার উচ্চারণ করেছেন নিজের নাম। বিজেপির গ্যারেন্টি নয়, মানুষের কাছে তিনি প্রচার করেন মোদীর গ্যারেন্টির কথা। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা অটল বিহারী বাজপেয়ী কখনোই এমন ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতি করেননি। তাঁর সময়ে বিজেপির বিরুদ্ধে অসাধু ও অসততার অভিযোগ প্রবল হয়ে ওঠেনি। ‘আমিই সব’, এ কথা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা তিনি করেননি। তাছাড়া রামমন্দিরের সব কৃতিত্ব মোদী যেভাবে একাই নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাও আরএসএস পছন্দ করেনি।
রাজনাথ সিং, নীতিন গড়কড়ির মতো সংঘ-ঘনিষ্ঠ বহু পুরনো নেতাদের মোদী জমানায় কোনঠাসা করা হয়েছে, । টিকিট দেওয়ার ক্ষেত্রেও আরএসএস নেতাদের কথাকে সেইভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সংঘের পছন্দের প্রার্থীকে তার নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য পার্টি থেকে আসা নয়া বিজেপি নেতার কথাতে। দিলীপ ঘোষ তার অন্যতম উদাহরণ। এই ভোটে আরএসএস কেবল খানিকটা নির্লপ্ত হয়ে মোদীর বিজেপিকে বুঝিয়ে দিল, ঘুড়ি মনে করে সে উড়ছে তবে লাটাই তাদেরই হাতে।