মেহেনাজ পারভিন
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সম্পর্কে একটি গল্প বারবার শুনতে পাওয়া যায় যা এইরকম: তাঁর এক মার্কিন সফরে, একজন আমেরিকান ভদ্রলোক খান সাহেবের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। বিত্তশালী সেই ভদ্রলোক খান সাহেবের সানাইয়ের সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বিসমিল্লাহ খানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বাড়ি কিনে দিতে চান আর বলেন সেখানে থেকে যেতে। খান সাহেব উত্তরে বলেন, যে তিনি তাঁর পরিবার এবং ছাত্রদের ছাড়া থাকতে পারবেন না। তখন ভদ্রলোক তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদেরও রাখার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। এরপর খান সাহেব আরেকটি শর্ত দেন।
তিনি বলেছিলেন যে,’আমি যখন দেশের বাইরে থাই, তখন ভারতকে মিস করি। আর যখন ভারতে থাকি কিন্তু বেনারসের বাইরে থাকি তখন বেনরাসকে মিস করি। আপনি কি এখানে আমার জন্য একটা বেনারস বানিয়ে দিতে পারবেন? সেই গঙ্গা, সেই গঙ্গার ঘাট, বেনারসের অল – বাতাস কি এখানে আনতে পারবেন? তাহলে আমি থেকে যেতে পারি।’ উত্তর শুনে সেই ভদ্রলোক নীরবে প্রস্থান করেছিলেন।
সম্ভবত, বিসমিল্লাহ খান এবং বেনারসের মধ্যে সম্পর্ক এই গল্পই সবথেকে ভালো বয়ান করে। যদি কেউ বিসমিল্লাহ খানের জীবন এবং বেনারসের ইতিহাসের উপর অনুসন্ধান করেন, অনুভব করবেন একজন শিল্পী ও একটি শহর যেন একই ভাগ্য ভাগ করে নিয়েছে। মনে হবে যেন তিনি এবং বেনারস একই চিন্তার দুটি রূপ। যেন সর্বশক্তিময় একটা ধারণা নিয়ে নিয়ে দুটি জিনিস তৈরি করেছিলেন; একটি হল বেনারস শহর; আর অন্যটি হল ব্যক্তি, বিসমিল্লাহ খান।
আরও পড়ুন: World Sparrow Day 2022: বানিয়েছেন ২.৫ লক্ষ পাখির বাসা, চিনে নিন ভারতের ‘নেস্ট ম্যান’কে
কারণ, যে উপমা দিয়ে আপনি বেনারসকে বর্ণনা করবেন, ঠিক সেই একই বিশেষণ আপনাকে প্রয়োগ করতে হবে খান সাহেবের কথা বলার জন্য। অর্থাৎ বেনারসকে বর্ণনা করার জন্য ‘মিথ’ -এর উল্লেখ ছাড়া সম্ভব নয়। ঠিক সেই একই ভাবে, বিসমিল্লাহ খানের মত সঙ্গীত প্রতিভার জন্মও কিংবদন্তির মতই গল্প কথা । কোথাও যেন বেনারস এবং বিসমিল্লাহ তাঁর স্বর্গীয় মোহময়তায় একাকার হয়ে আছে।
বেনারসের বালাজি মন্দিরে বসে রেয়াজ করতেন খান সাহেব। বেনারসের সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখেই তিনি তৈরি করেছেন অসংখ রাগ। বেনারসের ভোর ফুটে ওঠে তাঁর ভৈরব রাগে, সন্ধ্যা নেমে আসে ‘হংসধ্বনি’ তে। আর শেষ-সন্ধ্যায় খান সাহেব বাজাতেন নিজের অন্যতম প্রিয় সুর ইয়ামন। আপনি যদি পর্যটকে ঝোলা কাঁধ থেকে নামিয়ে বেনারসকে চিনতে চান, এর অলিগলি ঘুরে আসল ঐতিহ্যের সন্ধান পেতে চান, তাহলে এই সুর গুলো আপনি শুনতে পাবেন আপনার মনে- হৃদয়ে। ভক্তির চরম পর্যায় না পাওয়া থেকে যাবে খান সাহেবের ভৈরবী ছাড়া।
বিসমিল্লাহ খান বেনারসকে ভালোবাসতেন। তাঁর প্রাণের শহরের সবকিছুকে তিনি পছন্দ করতেন। আলাদা করে কিছু প্রমান করার তাগিদ তাঁর ছিল না। তাই তো খ্যাতির চরম বিন্দুতে যাওয়ার পর তিনি বেঁচে নিয়েছিলেন বেনারসের সেই এঁদো গলি, নিজের শ্যাওলা ভরা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরকে, যেখানে বসে তিনি বেনারসের ঘাট দেখতে পেতেন। গঙ্গা দেখতে দেখতে সানাইয়ে তুলতেন শাশ্বত সুর। সেই ঘর আজ প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে, চুরি হয়ে গিয়েছে তাঁর সানাই। কিন্তু এখনও তাঁর প্রাণের শহর আছে। যদিও সেটি থেকেও এই কিংবদন্তিকে মুছে ফেলার প্রয়াস চলছে অবিরত। নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টায় নির্লজ্জ, মিথ্যা আশ্রিত নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টা চলছে। তবে এইভাবে বিসমিল্লাহদের মুছে দেওয়া যাবে না। এঁরা মিশে রয়েছে বেনারসের ঘাটে, সেখানকার বাতাসে আর অজস্র মানুষের হৃদয়ে। বেনারস যতদিন থাকবে, ততদিন থাকবে বিসমিল্লাহ।