বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার কে উৎখাত করেন? এই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। এর জন্য কেউ পাকিস্তান ও আমেরিকাকে দায়ী করছেন, কেউ বলছেন অন্য কথা, কিন্তু এর পেছনে সবচেয়ে বড় হাত নাহিদ ইসলামের, যাঁর সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। আসুন জেনে নিই কে নাহিদ ইসলাম?
বাংলাদেশের ছাত্রনেতা তথা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। যে বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশ। ক্রমে তাঁর নেতৃত্বেই এক দফা দাবিতে পথে নামেন পড়ুয়ারা। পাশে দাঁড়ান বাংলাদেশের বহু সাধারণ মানুষ। যার জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং শেষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তবে ২৬ বছরের নাহিদ কিন্তু এখনই আন্দোলনের ময়দান ছাড়তে নারাজ। মৃদুভাষী নেতা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সেনাশাসন তাঁরা মানবেন না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠন করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকার।
নাহিদের জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকায়। বাবা শিক্ষক। মা ঘর সামলে সন্তানদের মানুষ করেছেন। ছোট এক ভাই রয়েছে তাঁর। নাহিদ বিবাহিত। তবে স্ত্রীর বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। জানা গেছে, নাহিদ ইসলাম বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তবে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন তিনি। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন জাতীয় সমন্বয়কারী বা কোঅর্ডিনেটর হিসেবে সামনে আসেন তিনি।
জুন মাসে তাঁর নেতৃত্বে কোটা সংস্কারের দাবিতে পথে নামেন বাংলাদেশের পড়ুয়ারা। উত্তাল হয় দেশ। মৃত্যু হয় শতাধিক মানুষের। ২১ জুলাই বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংস্কার মামলার রায় দেয়। সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশের পরিবর্তে সাত শতাংশ আসন সংরক্ষণের নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। যদিও তার পরেও আন্দোলন থামেনি নাহিদদের।
সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝেই নাহিদকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। তিনি দাবি করেন, ১৯ জুলাই সবুজবাগে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে তাঁকে ‘অপহরণ’ করেন ২৫ জন। নাহিদের দাবি, ‘অপহরণকারী’রা ছিলেন ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনী’র সদস্য। যদিও তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা পরেছিলেন সাধারণ পোশাকে। নাহিদ দাবি করেছেন, তাঁর হাত, চোখ বেঁধে অত্যাচার চালানো হয়েছিল। বার বার কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। নাহিদের ‘অপহরণ’-এর খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যে। রাতারাতি তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। নাহিদকে নেতা মেনে বাংলাদেশে তখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তার দু’দিন পর পূর্বাচলের কাছে একটি সেতু থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় আহত নাহিদকে। ভর্তি করানো হয় ঢাকার এক হাসপাতালে। পুলিশের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, নাহিদকে ‘অপহরণ’-এর বিষয়ে তারা কিছু জানে না।
যে দিন নাহিদকে অপহরণ করার অভিযোগ ওঠে, সেই ১৯ জুলাই নাহিদের দুই বন্ধু আসিফ মহম্মদ এবং আবু বকরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আন্দোলন চলাকালীন নাহিদ যখন, যেখানে গিয়েছেন, বক্তৃতা করেছেন, ছায়াসঙ্গীর মতো থেকেছেন আসিফ এবং আবু। পাঁচ দিন পর ওই দু’জনকে নির্জন একটি জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মাঝেই ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংস্কার মামলার রায় দেয়। মনে করা হয়েছিল, এর পর আন্দোলন স্তিমিত হবে। কিন্তু তা হয়নি। নতুন করে মাথাচাড়া দেয় আন্দোলন। ন’দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন সেই নাহিদ। তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে ‘সন্ত্রাসী’ বলেন। ধৃত আন্দোলনকারীদের মুক্তি, সমস্ত মামলা প্রত্যাহার, কোটা আন্দোলনে হামলাকারীদের শাস্তি-সহ আরও বিভিন্ন দাবি ছিল আন্দোলনকারী ছাত্রদের।
এর মাঝেই ২৬ জুলাই ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে আটক করা হয় নাহিদকে। আসিফ এবং আবুকেও আবার আটক করা হয়। তাঁদের পরিবারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে পরিচয় দিয়ে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও সংবাদমাধ্যমের তরফে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের সেই সময় জবাব মেলেনি। মনে করা হয়েছিল, এর পর আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে। কিন্তু তা হয়নি। নয় দফা দাবির পরিবর্তে একটি মাত্র দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করা হয় নাহিদদের তরফে— ‘হাসিনা সরকারের পদত্যাগ’।
সমাজমাধ্যম থেকে মাঠে ময়দানে ক্রমাগত প্রচার চালান নাহিদ। নতুন করে সক্রিয় হন আন্দোলনকারীরা। সেই আন্দোলনের জেরে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন হাসিনা। এর পর সাংবাদিক বৈঠক করে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান। সেনাপ্রধানের এই ঘোষণার পরে সোমবার রাতে একটি সাংবাদিক বৈঠক করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সদস্যেরা জানিয়ে দেয়, সেনা-সমর্থিত বা রাষ্ট্রপতি শাসিত কোনও সরকারকে সমর্থন করা হবে না। তাঁদের প্রস্তাবিত সরকার ছাড়া অন্য কোনও সরকারকে সমর্থন করা হবে না বলেও জানানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করার কথাও বলেছে সংগঠন।
এর পর সমাজমাধ্যমে একের পর এক ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন নাহিদ। কখনও জনগণকে শান্ত থাকার আর্জি জানিয়েছেন। কখনও সংখ্যালঘুদের রক্ষার কথা বলেছেন। তবে একটি কথা তিনি স্পষ্ট বলছেন, ‘‘ব্যক্তিকে সরালেই কেবল সমস্যার সমাধান হবে না, বরং যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে এ ধরনের ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়, সেই কাঠামোর বিলোপ করে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমাদের করতে হবে।’’